সাহিত্য এক অমল চিৎপ্রকর্ষ ভেতর-বাইরে যার সমপর্যায়ী আঘ্রাণ। এক অনিত্য অবস্থা থেকে নিত্যকালের হয়ে ওঠা সাহিত্যের মাধ্যমেই সম্ভব। চিত্তবৃত্তির এমন বহিঃপ্রকাশ অন্য কোনো শিল্পে দেখা যায় না। সাহিত্যের কাজ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের উক্তি প্রণিধানযোগ্য-‘অন্তরের জিনিসকে বাহিরের,ভাবের জিনিসকে ভাষায়,নিজের জিনিসকে বিশ্বমানবের ও ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়া তোলাই সাহিত্যের কাজ।’যুগে যুগে মানবের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, বিরাহ-আনন্দ, ব্যথা-বেদনা ও তার অনন্ত আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য বিরামহীন প্রচেষ্টা চালিয়ে যান কবি-সাহিত্যকগণ। আকার-প্রকারে, ভাবে-ভাষায়, সুরে-ছন্দে মিলেই তার বেঁচে থাকা। সাহিত্যের বিশাল ভুবনের অংশীদারিত্ব নিতে গিয়ে কেউ সফলতার চূড়ায় আরোহণ করেন, কেউ ব্যর্থতার গ্লানি বুকে বয়ে বেড়ান। বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের যে ঐতিহ্যের কথা আমরা বলে থাকি, সেখানেও রয়ে গেছে সেই বহিঃপ্রকাশের ইঙ্গিত।
বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’থেকে শুরু করে বর্তমান কালঅবধি সাহিত্যের বিস্তৃত ভূ-ভাগ জুড়ে প্রতিনিয়তই যে-সৃষ্টির উন্মাদনা লক্ষ্য করে আসছি, তাকে একটি ধারাবাহিক সৃষ্টির ইতিহাস ছাড়া অন্য কোনোভাবে অভিহিত করা যায় না। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা অর্থাৎ গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এগুলো যে-বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখকের অন্তহীন প্রচেষ্টার এক একটি সাক্ষ্য, এক একটি অনবদ্য সৃষ্টি, তা ভুললে চলে না। একটি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ অর্থাৎ তার সমগ্রকে জানতে হলে তার সাহিত্যের ইতিহাসকে অনিবার্যভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে হয়।
বগরা খাঁর নামানুসারে বগুড়া জেলা উত্তরবঙ্গের একটি প্রচীন জনপদ। করতোয়া নদীর তীরসংলগ্ন যে-ভূমিটি ছিল হিন্দু আমলের গৌড়েশ্বরের রাজধানী পুন্ড্রবর্ধন, হযরত শাহ্ সুলতান বলখী মাহীসাওয়ারের তীর্থভূমি আজাকের মহাস্থান, একদা অনেক মনীষী, পর্যটক, পীর-ফকির-আউলিয়ার পদপাতে ধন্য হয়ে উঠেছিল এই ছোট্ট জনপদ। ব্যবসা-বাণিজ্যের তীর্থকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বগুড়া। হিন্দু আমল, সুলতানী আমল, নবাবী আমল, বৃটিশ আমল ও পাকিস্তান আমল পেরিয়ে এই বাংলাদেশ পর্যন্ত বগুড়ার ইতিহাস বৈচিত্র্যের ইতিহাস, বহু শাসকের উত্থান-পতনের ইতিহাস, অত্যাচার, শোষণের ইতিহাস, বিদ্রোহ-আন্দোলনের ইতিহাস,বহু রক্ত-ত্যাগ-তিতিক্ষা-যুদ্ধ-স্বাধীনতার ইতিহাস।সব মিলিয়ে বগুড়া জেলার ঐতিহাসিক ভূমিকা অনিবার্যভাবে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। এই বিশাল ইতিহাসের পরিধিতে করতোয়াস্রোত বগুড়ার ভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছেন,প্রোথিতযশা অনেক কবি-সাহিত্যিক। তাঁদের রচনাকর্ম একদিকে যেমন একই জেলার গৌরবসময় ভূমিকাকে উজ্জ্বল করেছে,তেমনি এদেশের সাহিত্যাঙ্গনকে করেছে গতিশীল ও সমৃদ্ধ। শুধু তাই নয়,বগুড়ার প্রাচীনকালের কবি-সাহিত্যকদের রচনাবলীর দ্বারা যেমন আমরা আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে বারবার ফিরে পাই,তেমনি আধুনিককালের কবি-সাহিত্যকদের রচনাবলী দেশের তথা সাহিত্যের বিশ্ব-ইতিহাস অনুসন্ধানে আমাদের অনুপ্রাণিত করে। অতীত ও বর্তমানের এই মহামিলনের মধ্যে সেতু রচনা করতে আমরা যদি ব্যর্থ হই তাহলে আমাদের সকল ইতিহাস একদিন বিস্মৃতির অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার প্রয়োজন-একথা শুধু মুখে বললেই হবে না, সঠিক ইতিহাস রচনার মাধ্যমে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, বিকৃত ইতিহাসের মধ্যে নয়। আমি মনে করি, জেলার ইতিহাস লেখার পাশাপাশি আলাদা গ্রন্থে বগুড়া জেলার কবি-সাহিত্যেকদের জীবন ও তাঁদের রচনাকর্মের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা একান্ত প্রয়োজন, প্রয়োজন আমাদের মূল্যায়নের। আজ বগুড়াবাসীর অনেকেই বগুড়ার কবি-সাহিত্যকদের নাম জানেন না, চেনন না। জানেন না বগুড়ায় জন্মগ্রহণ করে চাকরিসূত্রে বা অন্যান্য কারণে জেলার বাইরে অবস্থান করেও সাহিত্যক্ষেত্রে অনেক সুনাম কুড়িয়েছেন এমন ব্যক্তির নাম এই জানাটা অত্যন্ত জরুরি। অন্তত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। আমরা আশা করবো,ভবিষ্যতে এ ধরনের দায়িত্ববান কেউ এগিয়ে আসবেন। ভাবতে অবাক লাগে প্রভাস সেনের বগুড়ার ইতিহাস, কে. এম. মেছেরের ‘বগুড়ার ইতিকাহিনী’ আমানউল্লাহ খানের ‘আজকের বগুড়া’ শামসুদ্দীন তরফদারের ‘দুই শতাব্দীর বুকে’ এবং এ ধরনের লেখা বইগুলো শুধু পুনমুদ্রণের অভাবে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে কে. এম. মেছেরের ‘বগুড়ার ইতিকাহিনী’ বইটি নতুন সংস্করণ প্রকাশ পেয়েছে। প্রভাস সেনের বইটি উডবার্ণ পাবলিক লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক সাহেব নিজের হেফাজতে রেখেছেন হারিয়ে যাবার ভয়ে। প্রভাস সেনের বইটি [প্রায়াত সাংবাদিক দুর্গাদাস মুখার্জীর তত্ত্বাবধানে] দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ পেলেও ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু পাঠ গ্রন্থটির সন্ধান জানেন কি-না আমার জানা নেই। এই যদি হয় বগুড়ার ইতিহাস গ্রন্থের অবস্থা তবে আমরা কীভাবে খুঁজে পাবো আমাদের ঐতিহ্য-ইতিহাস?
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস